লকডাউনগুচ্ছ
সুনীল শর্মাচার্য
.
করোনা এলো আমাদের দেশে…
কীভাবে তিনি আমদানি করলেন?
তা নিয়ে তর্কবিতর্ক থাক; প্রতিবাদ নেই
.
আমরা সবাই জানি : লকডাউনে
মানুষের ’পর অত্যাচার নিপীড়ন
খুব সহজেই চলে, শাসকের ইচ্ছা পূরণ
.
করোনায় যারা প্রয়াত-জীবিত লোকজন
সকলেই ভূভারতে তরলংজলবৎ…
.
সমস্ত কথার শিল্প নিয়ে কবি লেখক,
বুদ্ধিজীবী গহ্বরে লুকিয়ে, শব্দ নেই
.
সমূহ লজ্জা নিয়ে, অপমানে
অন্ধকার ঘরে বন্দী…
ছাতুখোর, বিড়িখোর, গাঁজাখোর
মদখোর, সুদখোর, ঘুষখোরে
ভরে আছে দেশ
গোপনে তাদের আঁতাত চলে…
.
এই নরনিধনের যজ্ঞ মেনে
মেরুদণ্ডহীন
.
বদনাম, ইতিহাস জানে
সব ঝাপসা হয়ে গেছে…
লকডাউনগুচ্ছ
দুই
করোনা কালে মিডিয়ার ছ্যাঁচড়ামি…
কিছু ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী রোজ রাতে আসর জমায়
সঞ্চালক বেশি বোঝে। তারা যা বলতে চান
মাঝপথে থামিয়ে দেয়। ঝগড়া-বিবাদে
ভাগ হতে হতে—কে যে কোন পক্ষ বোঝা দায়!
.
যারা ক্ষমতাসীন তাদের প্রভূত বন্দনা; ঠারেঠোরে
পক্ষদুষ্ট যশস্বীতায় অন্ধকারনামা…
.
আলো নেই। মানুষের দৈন্যতা নিয়ে রাজনীতি,
ব্যবসা চলে, বিপণন চলে—এই সংস্কৃতি!
.
আমজনতা ভালোই জানেন : মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ
বদল হয় না, বদলাবে না কোনোদিন!
.
ধোঁকা খেতে খেতে আমরাও ধোঁকাবাজ
তিলকে তাল শুনে জনমত গড়ি…
.
ভূভারতে সবই তো গট-আপ :
বলতে গেলেই বাঁধা, আইনের কচকচি
.
কীভাবে কখন কে মুখোশ বদলায়,
তারা জানে—জনতা নির্ঘাত গিনিপিগ!
লকডাউনগুচ্ছ
তিন
মার্কস সাহেব কেন যেন হাতের পাঁচটা আঙুল
সমান করতে চেয়েছিলেন? ভুল করেছিলেন :
এখন বুঝি! লক্ষ্যমুখ বাস্তবে খুব জ্বালামুখী!
পাঁচ আঙুল সমান হলে সমাজ আলগা হয়,
মুঠো সঠিক মুঠো হয় না, সে বড় অবৈজ্ঞানিক!
.
তবুও স্বপ্ন ছিল, নতুন সমাজ হবে সবার—
যেখানে থাকবেই মানুষের মৌলিক অধিকার
বাঁচার জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান…
.
স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল, অর্থ বড়ই দানবিক…
পুঁজির দাসত্ব ভাঙতে এখনো বিপ্লব অগ্রণী!
.
চার
আমরা ক্ষমতা পেলে হ্যানা করবো, ত্যানা করবো…
কোথাও আর রাস্তাঘাট খারাপ থাকবে না
মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে জল বিদ্যুৎ
কাজ পাবে, চাকরি পাবে, কেউ বেকার থাকবে না…
.
প্রতিশ্রুতি শুনে মানুষ প্রতিবার ভুল করে
প্রতিবার ভোটদানে দলদাস হয়ে পড়ে…
.
তারপর সবকিছুর রূপ বদলায়
কিন্তু মানুষের ভাগ্য আর বদলায় না!
.
পাঁচ
অর্থনীতি ছাড়া দেশ বাঁচে না, মানুষও বাঁচে না।
ছাই ওড়ে শ্মশানে, নিয়তি অধরা
চারদিকে হাহাকার। যুগ যুগান্তে একই চিত্র,
রাজার বাহার…
.
ভালোমানুষের মতো চুপচাপ থাকি, অনন্ত আকাশে
তাকিয়ে যেন বোবা পাখি
চতুর্দিকে আলোময়। আমার মনের খিলানের নিচে
থিকথিক আঁধার
পাগলের মতো ভাবি, খোলা দিগন্ত, খোলা প্রান্তর,
সবই আমার সপ্তাশ্ব কল্পনা
ভোর নামক শুভ সকাল বহুদিন দেখিনি।
চারপাশে অসুরী কলতান
কান ঝালাপালা, অলীক চিন্তা আলোকিত করে ঘর…
.
অর্থনীতি ছাড়া দেশ বাঁচে না, মানুষও বাঁচে না,
ছাই ওড়ে শ্মশানে, নিয়তি অধরা
রাজার আনন্দে ফুল পতঙ্গ পাখি গান করে,
আনন্দ ঈশ্বর!
চারদিকে হাহাকার, সমাজের ক্ষত দেখি আমার
কলিজায়!
.
ছয়
সমাজতন্ত্রও দেখি স্বৈরতন্ত্র হয়ে গেছে,
মানুষের কথা নেই, মানুষের মুক্তি মিছে!
.
গণতন্ত্রেও আজ দেখি স্বৈরতন্ত্রের ছবি
একবার ক্ষমতা পেলে ছাড়ে না তার দাবি!
.
হায় পৃথিবী, হিংস্র বন্যতা ছাড়ে না দেখি—
চারপাশে সমাজে আদিমতা প্রখর বেশি!
.
খুন-জখম-ঘৃণা-অত্যাচার এখন দামি
মন জঙ্গলে ভরে, মানবতা পশুত্বে নামি!
.
সাত
পর পর সবকিছুই পরিবর্তন হচ্ছে।
ক্ষমতার হিস্যা নিতে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ খেলা চলে
সব পক্ষই মাঠে নেমে হৈ চৈ : পরস্পর রোষ পোষে
তারই জের দেখি পথে পথে, চৌদিকে…
.
আমাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে অজানা ভয়ে!
ঘরে ঘরে চিন্তার ভ্রূকুটি, কি হবে? কি হবে?
কারো কেয়ার নেই, ব্যর্থ স্বার্থবিধি!
.
গবলগমপুত্র সঞ্জয়ের মতো দিব্যচক্ষু নিয়ে দেখি :
ব্যর্থ সব, আমাদের পরিচালনা যারা করেন…
.
মানুষ প্রতিদিন রাজাধিরাজের নাটক দেখে :
আর বিড়বিড় করে, ক্ষোভে বলে : অসভ্য শালা…
.
চারদিকে যা অসভ্য শব্দ রাজনৈতিক নেতারাই
ব্যবহার করে…
তাদের শব্দ কানে যেন জ্বলন্ত কয়লা,
পুড়ে পুড়ে ঝাঁঝরা করে মন!
.
সবাই ছচি, ছুতুক মানে? বে-নিশানে চরিত্রদোষ!
.
আট
গনগনে মৃত্যুর আঁচ বুকে নিয়ে চলেছি সবাই…
হুড়োহুড়ি দূরত্ব মুছেছে, গায়ে গায়ে উত্তাপ
.
যতই ঘোষণা হোক সামাজিক বিধি, কে মানে?
আমরা অস্থির, একরোখা গোয়ার!
আমাদের কোনো হেলদোল নেই, জেনেছি
জন্ম-মৃত্যু অনিবার্য পরম্পরা…
বিধি ভাঙছি মুর্হুমুহু : বাঁচার সলতে জ্বলে নিভু নিভু
.
কিছুতেই আর বিশ্বাস নেই
যেমন ইচ্ছে চলাফেরা দৈব্যের হাতে…
.
নয়
করোনা নিয়ে আমার মায়ের কোনো মাথাব্যথা নেই
সে তার পুরনো দিনের স্মৃতিতে মশগুল…
বেড়ে ওঠা শিশুকাল, রঙিন স্বপ্নের কিশোরীবেলা
তার চোখে আঁকে নানান ক্যানভাস…
.
বউচি খেলা, ধুলোবালি খেলা, পুতুল বিয়ে,
ঘর গড়া আর ঘর ভাঙা নিত্যি পাগল খেয়ালে
সে এক ঘোরকাটা মোহকাল…
.
নব বধূর বেশে সানাইয়ের সুর, মন উতল করা
নতুন ঘর আর নতুন সংসার—
সূর্য উদয় থেকে সূর্য অস্ত—ঘামে ঘামে কেটে যায়
.
মা, আমার মা—
হাজার দুখেও স্মৃতি খোড়ে…
স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে পেরিয়ে যায় গহীন বন…
সবুজ ধানক্ষেতে হাঁটে, হিজল তমাল ছায়ায়
ঘুরে ঘুরে দেখে গাজনের মাঠ, ইতুপূজো, নীল ষষ্টী
পহেলা বৈশাখ, হালখাতা, নতুন শাড়িতে আনন্দ অপার
.
আমার মা, মা—
চুপচাপ বসে থাকে—
জানালা দিয়ে দেখে সরাগাছ,
ডুমুরের পাতায় বসা টুনোটুনি,
হঠাৎ উড়ে আসা পাঁচিলে বসা দোয়েলের শিস
শুনতে শুনতে গাজনের মেলায় হারিয়ে যায়…
.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখে, মন্বন্তর দেখে, দেশভাগ দেখে
চোখের সামনে কতো কিছু যে ছারখার…
প্রিয় বসত, প্রিয় ঘরবাড়ি, প্রিয়জন হারা যন্ত্রণা, মৃত্যু
ক্ষুধা-অনাহারে প্রতিবেশী মানুষের হাহাকার…
মনে পড়লে তার চোখের অশ্রু নদী হয়ে যায়…
আমার মা করোনা নিয়ে ভাবে না, খিদেকে নিয়ে ভয়
তার হৃদয় কষ্টে ফালা ফালা তরমুজের মতো লাল,
তার হৃদয় কত শত ক্ষতে রক্ত ঝরে ঝরে জবা…
.
কত কাল গেল, কত কত লোকজন
মৃত্যু ছোবলে হারিয়ে উধাও…
মা, ভাবতে ভাবতে বলে : খোকা—
সাহস ধর, আশা ধর—
খারাপ সময় বেশি দিন থাকে না!
.
দশ
এত যে বড় বড় বিত্তশালী দেশ, শক্তিধর রাষ্ট্র
সব কুঁকড়ে গেছে করোনার ভয়ে;
সারা পৃথিবী স্তব্ধ, কোথাও টু-শব্দ নেই।
যান চলাচল নেই, আকাশে প্লেন নেই,
সমুদ্রে জাহাজ নেই, রাস্তায় লোকজন নেই,
সিনেমা হল, পাপ্প, রেস্তোরাঁ, জিম, মন্দির-মসজিদ,
সমুদ্র তট, সব লোক শূন্য। সবাই ঘরবন্দী।
.
এ কেমন অসুখ? দেখা যায় না, শুধু একজন
থেকে আরেকজনে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে;
ওষুধ নেই, ঘরবন্দী থাকলে বাঁচা যায় বিশেষজ্ঞগণ বলেন।
.
তবু ভাবি, কত কত সাজোয়া যুদ্ধ বিমান, কত কত রণতরী, কত কত পরমাণু অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র, মিশাইল, ট্র্যাঙ্ক
রাশি রাশি টাকা, অহঙ্কার আধুনিক বিজ্ঞান, সব অর্থহীন
কিছুই আর মানুষকে বাঁচাতে পারছে না!
হায়, দু হাজার কুড়ি সাল! বিষে কুড়ি কুড়ি…
.
তবু, পশুপাখিরা, অরণ্য, নদী, সাগর, পাহাড় হাঁফ ছেড়ে
বেঁচেছে
আকাশ বাতাস আজ সজীব শুদ্ধ, প্রকৃতি হাসে
চারদিকে নির্মল চকচকে পৃথিবী, আনন্দ সুন্দর—
বলছে : আমাকে দেখ, আমিও তোমাকে দেখি!
…………………
পড়ুন
কবির ভাষা কবিতার ভাষা : সুনীল শর্মাচার্য
সুনীল শর্মাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
72 thoughts on “লকডাউনগুচ্ছ”